গতি ধীরও হলেও উপনিবেশবাদের ছায়া থেকে বের হচ্ছে প্রত্নচর্চা
Published : May 26 2025 , 1:00:0 am
Written By : bdfeature
রোবইয়ান হ্যাম্ফায়ার্স ও তার টিমের ভাবনা অনুসারে লেখা
যখনই "পুরাতত্ত্ব" শব্দটি আমাদের কানে আসে, তখন অনেকেই ভাবেন সেই দুঃসাহসিক অভিযানের নায়ক ইন্ডিয়ানা জোনসকে—একজন চলচ্চিত্র চরিত্র, যিনি বিপদসংকুল পথে হেঁটে প্রাচীন নিদর্শন উদ্ধার করেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। প্রকৃত পুরাতত্ত্ব শুধু ধ্বংসাবশেষ খোঁজার রোমাঞ্চ নয়; বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং মানবিক সম্মান রক্ষার এক পরিশ্রমসাধ্য অনুসন্ধান।
ইন্ডিয়ানা জোনসের মতো চরিত্রগুলোর মাধ্যমে যে পুরাতত্ত্ব চিত্রিত হয়েছে, তা বাস্তবের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি প্রায়ই প্রাচীন নিদর্শন উদ্ধার করতে গিয়ে যে "প্রেক্ষাপট তথ্য" ধ্বংস করেন—যেমন ঐ স্থানটির প্রাকৃতিক অবস্থা, নির্মাণ সামগ্রী, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব—তা একটি নিদর্শনের গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপনিবেশবাদের ছায়াতলে পুরাতত্ত্ব
ইন্ডিয়ানা জোনস কেবল একজন দুঃসাহসিক চরিত্রই নন; তিনি একটি বৃহত্তর সমস্যার প্রতীক। তাঁর কর্মকাণ্ড বহুবার এমন এক মানসিকতা তুলে ধরে, যেখানে উপনিবেশবাদী মনোভাব বৈধতা পায়। চলচ্চিত্রগুলোতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা, সহিংসতা এবং নিদর্শন সংগ্রহে নৈতিকতার অনুপস্থিতি—এসব আসলে অতীতের সেই উপনিবেশবাদী পুরাতত্ত্বচর্চারই প্রতিফলন।
উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাপুংবুয়ে বা জিম্বাবুয়ের গ্রেট জিম্বাবুয়ের মতো প্রত্নস্থলগুলোকে একসময় আফ্রিকান জনগণের কীর্তি না বলে পার্সিয়ান বা বাইরের জাতিগুলোর কীর্তি বলে চালানো হয়েছিল। এসব কাজ প্রমাণ করে, কীভাবে "বিজ্ঞান" ব্যবহার করে বর্ণবাদ এবং সাংস্কৃতিক দখলদারিত্বকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
বদলাচ্ছে ধারনা, কিন্তু যথেষ্ট নয়
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও, সমস্যার শিকড় এখনো গভীর। আফ্রিকার অনেক দেশে গবেষণার আইনি কাঠামো থাকলেও, অনেক বিদেশি গবেষণা প্রকল্প এখনো স্থানীয় গবেষক ও জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে চলে। প্রায়ই দেখা যায়, স্থানীয়দের জ্ঞান ব্যবহৃত হলেও তারা স্বীকৃতি পায় না, এমনকি সেই গবেষণার ফলাফলও তাদের ভাষায় বা গ্রহণযোগ্য রূপে তাদের কাছে পৌঁছায় না।
উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়ার এক প্রাচীন শহর সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মৌখিক ইতিহাস ও জ্ঞান থেকে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাটাটিয়েলের শিলাচিত্র নিয়ে গবেষক এনথাবিসেং মোকোয়েনা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এক নতুন ধরণের গবেষণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যেখানে পবিত্র স্থানগুলোর মর্যাদা রক্ষা পেয়েছে।
নৈতিক পুরাতত্ত্ব: একটি জরুরি প্রয়াস
পুরাতত্ত্বে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন এক দৃষ্টিভঙ্গিগত বিপ্লব। কেপটাউনের হিউম্যান ইভোলিউশন রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ লক্ষ্যে কাজ করছে—স্থানীয় ও তরুণ আফ্রিকান গবেষকদের ক্ষমতায়ন, তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন, এবং গবেষণায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
এই চেষ্টাগুলো কেবল একটি নিদর্শন উদ্ধারের কাজ নয়; এটি আসলে ইতিহাসের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ—যেখানে আফ্রিকার ইতিহাস কেবল ইউরোপীয় জাদুঘরে নয়, আফ্রিকানদের হাতেও থাকবে, আফ্রিকানদের গল্প তাদের নিজের মুখেই বলা হবে।
শেষ কথা: ইন্ডিয়ানার বদলে নৈতিক গবেষক
ইন্ডিয়ানা জোনস এক রোমাঞ্চকর চরিত্র হলেও, তিনি পুরাতত্ত্বের সত্যিকার প্রতিনিধি নন। তাঁর মতো "নায়ক" নয়, আমাদের দরকার এমন গবেষক, যারা শ্রদ্ধাশীল, নৈতিক, এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। কারণ নিছক একটি নিদর্শন নয়, সেই নিদর্শনের সঙ্গে জড়িত মানুষের স্মৃতি, বিশ্বাস, আর ইতিহাস—সেইটিই আসল সম্পদ।
নতুন দিনের পুরাতত্ত্বে ইন্ডিয়ানাদের আর জায়গা নেই। এখন দরকার নৈতিকতা, সম্মান, আর সহভাগিতার ভিত্তিতে দাঁড়ানো নতুন এক অনুসন্ধান।
যাওয়ার আগে...
আমাদের বিনামূল্যের নিউজলেটারগুলি প্রতিদিন সকালে আপনার ইনবক্সে উজ্জ্বলতম একাডেমিক লেখকদের কাছ থেকে সরাসরি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য নিয়ে আসে।