মুদ্রা সংগ্রহ থেকে পাঠোদ্ধার ও গবেষণার নেশা
Published : June 18 2025 , 2:03:45 pm
Written By : bdfeature
অধ্যাপক ড. শরীফুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ বিভাগের শিক্ষক তাঁর অন্য পরিচয় মুদ্রা গবেষক ও সংগ্রহক। তাঁর এই স্বপ্নপূরণের ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছে বাড়তি মাত্রা। নিজে আইবিএ বিভাগের হলেও তাঁর দুটো গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। প্রথম বই ‘আন্ডাস্ট্যান্ডিং দ্যা কয়েনস অব বেঙ্গল- অ্যানসাইন্ট টু আর্লি মর্ডান পিরিয়ড’ তাঁর এ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অব দ্যা অরিয়েন্টাল নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি তাকে অশোক প্রাইজ দিয়েছে ২০১৮ সালে। ‘দ্যা সুলতানাত পিরিয়ড কয়েনস অব বেঙ্গল’ এটি লেখকের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হলেও তার মুদ্রাবিষয়ক দ্বিতীয় বই। তাঁর মুদ্রা বিষয়ক গবেষণা ও শিক্ষাজীবনের
গল্প শুনেছেন , কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মুতাসিম বিল্লাহ
কিভাবে হয়ে ওঠলেন মুদ্রা গবেষক?
কালেকশনের নেশা ছিলো ছোট বেলা থেকে। তবে বাস্তবতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। বাবার কষ্টার্জিত মধ্যবিত্ত জীবনের সংগ্রাম হয়ত বুঝতে দিতেন না, কিন্তু তা যে পরিমিত অতিরিক্ত নয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেতাম। তাই বিভিন্ন বিষয়ে সংগ্রহ করার আগ্রহ থাকলেও তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর সে স্বপ্নকে সত্যি করেছি, মুদ্রা সংগ্রহের গল্পটা বেশ মজার। একদিন বাবার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী মিউজিয়ামে যাওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে আগের আমলের বিভিন্ন কয়েন বিক্রির কথা জানতে পারি। এরপরে প্রাথমিকভাবে সেখান থেকে কয়েকটা মুদ্রা কেনা শুরু হয়, সেগুলো কালের বিবেচনায় খুব বেশি পুরনো ছিলো না। পরবর্তীতে কয়েকটা দোকানে পুরনো মুদ্রা কেনার আগ্রহ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তারাঁ বিক্রির খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। একজন অবশেষে বিক্রির উদ্দেশ্যে মুদ্রা দেখাতে রাজি হয়েছিলেন, এভাবে বিভিন্ন গ্রæপে ঢুকে, নেদারল্যান্ডস এর ক্যানভার্ড ব্রিটিশ, ইন্ডিয়ান রুপী সংগ্রহ করি। সেগুলো ছিলো পাকিস্তান ও ব্রিটিশ আমলের রুপী। ছোট বেলায় দাদার ট্রাঙ্কের ভেতর একটা মুদ্রা পেয়েছিলাম। সেটি ছিলো ১৯০৭ সালের। তখন এটিকে য²ের ধনের মতো আগলিয়ে রেখেছি। পরে ওখানে গিয়ে দেখি আরও আগের সময়ের মুদ্রা পাওয়া যায়। এরমধ্যে বিভিন্ন মুদ্রা সংগ্রহ করার নেশায় বিভোর হয়ে যাই। একটা সময় এসে শখ জাগে মুদ্রাগুলো পাঠোদ্ধার করার। এরপরে জানতে পারেন ‘মুদ্রা’ বিকিকিনির জন্য বিভিন্ন প্লাটফর্ম এর কথা। এর একটি হলো ‘ওয়ার্ল্ড অব কয়েনস’। একদিন আমি অ্যারাবিক মুদ্রা পেলাম, তখন আমি অ্যারাবিক মুদ্রা পড়তে পারতাম না। তাই আমি এ মুদ্রা পাঠোদ্ধারের জন্য ‘ওয়ার্ল্ড অব কয়েনস’ এ পোস্ট করলাম। একজন আমাকে বললেন মুদ্রাটি দিল্লীর, হয়ত তা মোগল বা সুলতানি আমলের হবে। এরকম যে মুদ্রাগুলো পেতাম তা ওয়ার্ল্ডস অব কয়েনস এ পোস্ট করতাম। ওখানে একজন বিখ্যাত মুদ্রা সংগ্রহকারী এবং গবেষক ইয়ানমিয়ান আমাকে পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি যেহেতু মুসলিম, তুমি যেহেতু কুরআন পড়ো, তুমি তো অ্যারাবিক পড়তে পারো, তোমাকে আমি পড়ামর্শ দিচ্ছি তুমি সুলতানি মুদ্রার উপর অধ্যয়ন করো’। তিনি আমাকে এ উদ্দেশ্যে একটা বই পড়তে বললেন বইয়ের নাম হলো ‘কয়েনস অব ইন্ডিয়ান সুলতানাত’ এটি গোরেন এবং কোয়েনকোর লেখা।
ভাবনা ছিলো বইটি সহজেই পাবো কিন্তু দেশের কোথাও পেলাম না, ইন্ডিয়াতেও কয়েকবার অনুসন্ধান করার পর পেলাম না, ‘ওয়ার্ল্ড অব কয়েনস’ এর আরেকজন মেম্বার অমিত মেহতা বাংলাদেশে প্রায়ই আসতেন, ওনারা বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে মেশিন সাপ্লাই দিতেন, উনার সাথে কথা বলে বিভিন্ন অকশন হাউস ঘুরে ঘুরে তাঁর পরে সংগ্রহ করে আমাকে দিলেন। ৬ হাজার টাকা দিয়ে সেটা কিনেছিলাম, বর্তমানে এর দাম আরও অনেক বেড়ে গেছে। এটা মুলত একটা ক্যাটালগ। এই বইয়ে মুদ্রার এপিট ওপিঠ এ যা আরবিতে লেখা থাকত তা মুদ্রার পাশাপাশি লেখা ছিলো। বইটি নিয়ে আসার পর যেহেতু আমি আরবিতে অনেক বেশি অভিজ্ঞ নই সে হিসেবে শুরুতে অন্ধের মতো কয়েনের লাইনগুলো ঐ বইয়ের সাথে মিলানোর চেষ্টা করতাম। সেক্ষেত্রে মুদ্রা থেকে নতুন কোনো তথ্য বের করা সম্ভব না, পুরনো কোনো তথ্য থাকলে তা হয়ত মিলিয়ে মিলিয়ে বের করা যাবে। ৬-৭ বছর এরকম মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং তা ক্যাটালগের সাথে মিলিয়ে দেখলাম মুদ্রাগুলো ক্যাটালগে অনুপস্থিত। ফলে অনুভব করলাম যদি আমি এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণা করি তা ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। উদাহরণ হিসেবে নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের কথা বলতে পারি। আমার কাছে ও আমার বন্ধুর কাছে প্রাপ্ত মুদ্রার থেকে দেখি তার শাসনআমল সম্পর্কে আমাদের নতুন তথ্য দিচ্ছে। পূর্বে তার মুদ্রা পাওয়া যেত ৮৩৭ হিজরি থেকে। প্রচলিত ইতিহাসে মাহমুদ শাহ এর শাসনআমলের শুরু ধরা হতো ৮৩৭ হিজরি থেকে। যদিও রিয়াজুস সালাতিন এ তাঁর শাসনকাল বলা হয়েছে ৩২ বছর। অন্য উৎসগুলোতে বলা হয় ২৭ বছর। আমরা এই বিভ্রান্তি দূর করতে অগ্রসর হলাম। প্রাপ্ত মুদ্রা এর বিভ্রান্তি নিরসনে ভূমিকা রেখেছে। আমি ও মুদ্রাগবেষক নোমান নাসির এর যৌথ গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি তার শাসনকাল ৮৩২ হিজরী। ফলে রিয়াজুস সালাতিন এ বর্ণিত শাসনকাল ই যে সঠিক তা প্রমাণে আমরা সফল হয়েছি, আমাদের কাছে প্রাপ্ত ৮৩২ হিজরীর মুদ্রার ভিত্তিতে। এ সময়ে শাসন ক্ষমতায় জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ও ছিলেন, প্রাপ্ত মুদ্রা বলছে তাদের সাথে তাদের সম্ভবত ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ছিলো। সুলতানি আমলের মুদ্রা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখি নতুন সুলতান সিরাজ আল দীন এর মুদ্রা পাচ্ছি। এই নামে ইতিহাসে কোনো সুলতানের মুদ্রা আমরা এর আগে পাচ্ছি না। এই মুদ্রার অবয়ব বাংলায় প্রাপ্ত মুদ্রার অবয়বের সাথে মিলে যায়। পরে এই মুদ্রাকে ঘিরে আমাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। এবং সে যে বাংলায় ছিলো তা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে আমরা গবেষণা করলাম। অবশেষে আমরা ইতিহাসে তাঁর নাম পেয়েও গেলাম যা কিনা ইতোঃপূর্বে সালিম উল্লেখ করেছিলেন, তিনি গিয়াসউদ্দীন আজমশাহের শাসন আমলে একজন কাজী ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ সময় ধর্মীয় ও কুটনৈতিকভাবে বহিঃবিশ্বের সাথে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। মুসলিম বিশ্ব, পূর্ব আফ্রিকা, চায়নাতে। ব্যবসা, ধর্ম, কুটনীতি জুড়ে ছিলো এ সম্পর্ক। মক্কা, মদিনাতে এসময় তিনি মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন, মিশরের খলিফাকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তার গৌরবউজ্জ্বল পরিচয় ছড়িয়ে পরেছিলো। সে হিসেবে তাঁর কাজী সিরাজ-আল-দ্বীনও ছিলেন প্রতাপশালী কাজী, তবে সুলতান ও তাঁর পরিবারের প্রতি অনুগত। ধারণা করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রে সুলতান গিয়াসউদ্দীন ও তাঁর পুত্র হামজা শাহ মারা গেলে তা হয়ত এই কাজী মেনে নিতে পারেননি। এবং তিনি হয়ত সেখান থেকে পালিয়ে পূর্ব দিকে গিয়ে বাইজিদ ও রাজা গণেশ এর প্রতি বিদ্রোহ প্রকাশ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। মুদ্রাও জারি করেছিলেন। কিন্তু শেষমেষ তা রক্ষা করতে পারেননি। নিজেকেও প্রাণ দিতে হয়েছিলো।
এরপরে এই মুদ্রাগবেষণা করতে গিয়ে নতুন টাকশাল ‘বালাপুর’ কে আবিষ্কার ও তা সনাক্ত করার চেষ্টা করলাম। বালাপুর শব্দের অর্থ বন্দর। শব্দটি ছিলো বালাবুর সেখান থেকে হয়েছে বালাপুর। গুগল ম্যাপে আমরা বালাপুরের সন্ধান করে দুটো জায়গা পেলাম। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সীমান্তঅঞ্চল এবং ইন্ডিয়ার পশ্চিম বাংলা। আরেকটি হলো মেঘনা নদীর তীরঘেষে নরসিংদী জেলার একটি এলাকা। এর আরেক অংশ হলো কুমিল্লা জেলায় যা একসময় ত্রিপুরা রাজ্যর অংশ ছিলো। এই এলাকার বালাপুর নামক জায়গাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর ছিলো, এর পাশে এখনো নবীন চন্দ্র সাহা এর জমিদার বাড়ীর ধ্বংসস্তুপ দৃশ্যমান। সার্বিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় মনে করা হচ্ছে এটি আদি ও মধ্যযুগে গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌ-বন্দর ছিলো, ত্রিপুরা থেকে বাংলায় আসার প্রবেশ পথ ছিলো এই বালাপুর। এ বিষয়ে আরও গবেষণা বিষয়টিকে পূর্ণমাত্রা দিবে। বিষয়টি এমনও হতে পারে নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ ও জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহের দ্ব›েদ্বর সুযোগে বালাপুর হয়ত কিছু দিনের জন্য ধর্মমাণিক্যের সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
স্টেন গোড়েন ও জে.পি গোয়েনকা এর বই পড়ে, এরপর নোমান নাসিরের সাথে যৌথ কাজ করে মুদ্রার ওপর ‘রিসার্চ আর্টিকেল’ লেখার ফরমেটটি বুঝে ফেললাম। একটা ধারণা পেলাম মুদ্রার উপর কিভাবে কাজ করা যায়। আমি নিজেকে অনেক ভালো মানের গবেষক বলব না, তবে আমার কাছে যে ‘সংগ্রহ’ ছিলো সেখান থেকে ৮-৯টি নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যা ইতিহাসকে নতুন করে পুনর্গঠন করবে, সংযোজন করবে।
আমার এই বইয়ের মেথডলজিটা ছিলো মুদ্রা পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নবীশ গবেষকদের যে সমস্যা হয় তা সমাধানের চেষ্টা করা, মুদ্রার প্রত্যেকটি শব্দকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়ে দেওয়া। পাঠক যেন মুদ্রার লেখাগুলো সহজে নিজে বুঝে বুঝে পড়তে পারে। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বইটি লেখা হয়েছে। তাহলে আমার মতো আরও যাদের কাছে মুদ্রা আছে তারা হয়ত এই বইটি থেকে জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে তাদের হাতে থাকা মুদ্রারও পাঠোদ্ধার করতে পারবে। আগের বইটাতে নিজের হাতের ড্রয়িং ছিলো, দ্বিতীয় বইটাতে প্রফেশনাল আর্টিস্টকে সাথে নিয়ে মুদ্রার স্পেসিমেনকে অলঙ্কৃত করার চেষ্টা করেছি। তিনি হলেন, বাংলাদেশের বিশিষ্ট ক্যালিগ্রাফার আবদুর রহীম ভাই। তার সহায়তায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে আমরা ক্যালিগ্রাফির কাজটি করেছি।
৭ বছরের মতো সময় পার হয়েছে, বিশিষ্ট মুদ্রাগবেষক নোমান নাসির আমাকে বিভিন্নভাবে নানা সময়ে সহযোগিতা করেছেন, পরবর্তী বইয়ে ৯টি নতুন ফাইন্ডিং পেলাম, আগের ফাইন্ডিংগুলো ভেঙ্গে খুলে খুলে বর্ণনা করারও উদ্যোগ নিলাম যাতে করে এ বিষয়ে যারা কাজ করতে চায় তারা যেন তা বুঝতে পারে।
প্রথম বই প্রকাশ হয়েছে নিউ দিল্লীর ‘মনোহর’ পাবলিশার থেকে। এই বইয়ের নাম ছিলো ‘আন্ডাস্ট্যান্ডিং দ্যা কয়েনস অব বেঙ্গল- অ্যানসাইন্ট টু আর্লি মর্ডান পিরিয়ড’ মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সুলতান, এবং এ সময়ে বাংলায় ছোট ছোট কিছু রাজ্য ছিলো সে রাজ্য মুদ্রাগুলো নিয়ে লিখেছি, হরিকেলার কথা বলতে পারি, আগের অন্যান্য লেখকের লেখা থেকে ত্রিপুরা, কুচবিহার, সুবর্নগ্রামের, চাটিগাও, শ্রীহট্ট এর মুদ্রাগুলো নিয়ে এসেছি। মনোহরকে বইটি দেওয়ার পর তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিলো বইটি রিভিউ করানোর। প্রায় ১বছর পরে তারা আমাকে জানালো তারা বইটি রিভিউ করতে পারছে না, বইয়ে একই সাথে বিভিন্ন সময়কালের মুদ্রা থাকায়, যার সময়কাল ও ভাষাগুলো আলাদা। তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলাম চ্যাপ্টার অনুযায়ী রিভিউ করানোর। সে পরামর্শ অনুযায়ী বইটি করল। বইটি করতে গিয়ে ‘পেশাদারিত্বের দারুন অভিজ্ঞতা হয়েছিলো’ কিন্তু সমস্যা ছিলো বইয়ের মুল্য নিয়ে। এর দাম পৃষ্ঠা অনুযায়ী অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিলো। ৩৩৯৫ রুপী। ডিসকাউন্টের পরেও ৩৫০০ এর মতো দাম হয়ে যায়।
পরবর্তীতে বাংলার সালতানাত কে নিয়ে আলাদা বই করার পরিকল্পনা করলাম, মেথডটাও আলাদা করলাম। এ বইয়ে ৭৭টি মুদ্রা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এর ছবি ড্রয়িং এ প্রায় ৬-৭ মাস সময় লেগেছিলো আবদুর রহীম ভাইয়ের, আগের বইয়ে সহ-লেখক হিসেবে ছিলেন, মোশাররফ হোসেন, তিনিও এই বইয়ে কন্ট্রিবিউটরস হিসেবে কাজ করেছে। আমরা দুজন মিলে আবার এগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে ইলেসটেটর এ করেছিলাম। তাতে আমাদের আরও ৬-৭ মাস লেগেছিলো, সবকাজ শেষ করে কমপাইল করার পর বøাক অ্যান্ড অরেঞ্জ কে দিয়ে প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলাম। শাকিল ভাই খুব প্রফেশনাল তাই তাকে দিয়ে কাজটি করালাম।
এ কাজ করতে গিয়ে আমার অনেক পরিবর্তন এসেছে, বাংলাদেশি ও বাঙালি জাতীয়বাদের বিষয়টি বোঝাপড়া সহজ হয়েছে। আগে ইতিহাস বলতে বুঝতাম, ৪৭, ৫২, ৭১, এই কয়েকটি টাইমফ্রেমকে ঘিরেই ছিলো ইতিহাসের জ্ঞান। এই দেশের মানুষেরাই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য এ দেশের মানুষেরা রক্ত দিয়েছে, অন্যরা দেয় নাই। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমি বুঝতাম না, মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়ে, প্রাপ্ত মুদ্রার সময়কাল ঘাটতে গিয়ে ওই সময়ের ইতিহাসকে পড়তে হয়েছে, জানতে হয়েছে, এর কাছাকাছি সময়কালকে জানতে হয়েছে। সুলতানি আমল জেনেছি, আর আগের সময়কাল, মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল, সেন সময় সম্পর্কে অল্প কিছু জেনেছি। আগে কিছুই জানতাম না, আমাদের পাঠ্য বইয়েও এগুলো তেমন ছিলো না, আর কেউ এগুলো পড়তেও বাধ্য করেনি ফলে এই ইতিহাসগুলো জানা ছিল না। যে আমলের মুদ্রাগুলো পাই সে সময়টা ঘাটতে হয়েছে। এই সময়ের কাছাকাছি শাসনআমলগুলোও জানতে হয়েছে। নিজেকে, নিজের পরিচয়কে আগের চেয়ে আরও গভীরে বুঝতে এ মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মুদ্রা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ক্ষতি হয়নি নিজ বিভাগের?
আমি পড়া ও পড়ানোর মানুষ। এর বাইওে কোনো আড্ডা বা অন্য কিছুর সাথে আমার সম্পর্ক নাই। যেহেতু পড়ানোর পাশাপাশি অন্যকোনো কাজ নেই তাই অবসরের সময়টুকুতে এই মুদ্রার ওপর কাজ করেছি। মুদ্রার গবেষণা আমার মুল গবেষণায় কোনো সমস্যা তৈরি করেনি।
কৈশোরের না পড়–য়া থেকে পড়–য়া জীবন জানতে চাই?
নিয়মিত ফেল করতাম। বুঝতাম না কিভাবে গাণিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে হয়। অঙ্ক কেমন করে এমন হয়, সেটিই বুঝতাম না, সমাধান করা তো পরের কথা। এ জীবনটাতে বাসায় পরিবারে ভালো ছেলের কোনো উদাহরণ টানলে আমার যে চাচাত ভাইয়েরা আছে তাদের নাম থাকত। এর বিপরীত চরিত্র হিসেবে আমার নামটি উদাহরণ হিসেবে আসত। এটি আমার জন্য খুব কষ্টের কারণ ছিলো। নবম শ্রেণিতে হঠাৎ একদিন মনে হলো এমন জীবনের কোনো মানে হয় না। একটু দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।
তখন আমি কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে। একদিন সবগুলো বই নিয়ে পড়তে বসি, বাবা এসে দেখে বললেন, কি ব্যাপার তুমি উঠছ না কেন? আমি অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিলাম। আমি বললাম আজ থেকে আমি পড়াশোনা শুরু করলাম। বাবা বললেন, “দেখা যাবে কদিন টেকে এই চেষ্টা”। সে যেন আমার অগ্নিতে ঘি ঢেলে দিলেন, আমি আর উঠলাম না, আমার ১দিনের পরিবর্তনে বাসায় কেন্দ্রিয় চরিত্রে আবির্ভূত হলাম। এটা আমাকে খুব আনন্দ দিলো। পরদিনও পড়া শুরু করলাম, ডায়রী নিয়ে পড়তে বসলাম, নিয়মিত ৭-৮ ঘন্টা পড়াশুনা করছি, পরিবারে দেখি আমার কদর বেড়ে গেছে, বাবা বলে দিলেন, কেউ যেন আমাকে ডিস্টার্ব না করে, ওর যেন সব কথা শোনা হয়, আমার কি কি দরকার সে বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া বেড়ে গেল, আমার জন্য যেন রাজকীয় পরিবেশ হয়ে গেল বাসায়। একটা অন্য জীবনের আনন্দ অনুভব করলাম। ডেস্ক ক্যালেন্ডারে নোট করতাম দিনে কয়ঘন্টা পড়ি, এটা একটা নেশায় পরিণত হলো, কয়ঘন্টা পড়ি রেগুলার সেটা গণনা করতে। নবম শ্রেণির মাঝামাঝিতে আমি এমনটি শুরু করেছিলাম। এসএসসিতে ফাস্ট ডিভিশন এলো। আব্বা আমাকে নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছেন আমাকে নিয়ে, লেখার নোট গুছিয়ে দিতেন, বানান ঠিক করে দিতেন, হাতের লেখা সুন্দও করার বিষয়ে গাইড দিতেন। নবম শ্রেণি থেকে অ আ ক খ থেকে এ বি সি ডি এগুলো লিখে লিখে হাতের লেখাও পরিবর্তন করেছিলাম। সায়েন্সে ছিলাম, বাবা পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি যেহেতু দেরিতে পড়াশুনা শুরু করেছো, এইচএসসিতে কমার্স নেও।’ সে সময় কলেজে আগে কমার্স ছিলো না। সবাই যেহেতু শুরু করবে নতুন থেকে, তাই বাবার পরামর্শ অনুযায়ী কমার্স নিলাম। বাবা আমার জীবনে কোচের ভূমিকা পালন করেছে।
কলেজ থেকে কখনো আর সেকেন্ড হইনি, কলেজের সায়েন্স, আর্টস ও কমার্স এর যে যৌথ রেজাল্ট সেখানে আমার ১০ এর মধ্যে পজিশন ছিলো, আমাকে দেখতে সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা এসেছিলো। ১৯৯২ সালে কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে আমি কমার্স নিয়ে বোর্ডে ফাস্ট হয়েছিলাম ৮১৫ পেয়ে। যে সেকেন্ড হয়েছিলো সে পেয়েছে ৭৫২। পরে ঢাবিতে ভর্তি হয়েছিলাম। অ্যাকাউন্টিং এ। পজিশন ছিলো ১৩তম। কিছুদিন থাকার পর হলের পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে ঝামেলা হওয়ায় একই বছরে, রাবিতে অ্যাকাউন্টে ভর্তি হলাম।
অনার্সে বিভাগে ফাস্ট ফ্যাকাল্টিতে সেকেন্ড ছিলো পজিশন, মাস্টার্সে ফাস্ট ফ্যাকাল্টিতেও ফাস্ট হয়েছিলাম। কর্মজীবনে ব্যাংকে, দুটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০১ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় চাকুরি করে রাজশাহীর আইবিএতে ২০০৪ সালে যোগদান করি। উচ্চ গবেষণায় স্কলারশিপ পাইনি। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এডমিশন নেওয়ার প্রক্রিয়া ছিলো, অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচিডির অফার পেয়েছিলাম, তবে ফুল স্কলারশিপ পাইনি তাই, ঝুকি নিইনি। সুইডেন থেকে মাস্টার্স করে এসেছি, মাস্টার্স করতে গিয়ে দেশে মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র রেখে ১বছর অনেক মিস করেছি। নিজেকে খুব ক্লান্ত লেগেছে। এজন্য ওখান থেকেই দেশে ফিরে আসার
আপনার জীবনগড়ার ‘মেন্টরস’?
ছাত্র জীবনে আমার মেন্টর ছিলেন আমার বাবা প্রফেসর মোঃ নজরুল ইসলাম। কর্মজীবনে তিনি পেশায় ছিলেন কলেজ শিক্ষক। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রায় তিন বছর। শিক্ষকতা জীবনে আমার মেন্টর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ফিরোজ আহমেদ; আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ মোঃ মহসিন-উল ইসলাম এবং প্রফেসর ডঃ মোঃ আখতার উদ্দিন। নিউমিসম্যাট্রিকস এ আমার মেন্টর লন্ডনের স্ট্যান গরন যিনি তাঁর প্রখ্যাত নিউমিসম্যাটিক বুক ঈড়রহং ড়ভ ওহফরধহ ঝঁষঃধহধঃব এর জন্য নিউমিসম্যাট্রিকস জগতে একজন আইকন। এ ছাড়াও প্রখ্যাত গবেষক/লেখক কানাডার ওন্টারিওতে বসবাসরত জন ডেয়েল এবং বৃটিশ মিউজিয়ামের প্রাক্তন কিপার প্রখ্যাত গবেষক/লেখক লন্ডনের জো ক্রিবের সাথে আমার কাজ করার সৌভ
মুদ্রা নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা কী?
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক এর সাথে বাংলা ভাষায় একটি কাজ করছি। আমাদের সাথে আমার বন্ধু মোঃ মোশারফ হোসেন কাজ করছেন। এছাড়াও অধ্যাপক শাহেদ হাসান এর সাথে আমার আরেকটি কাজের পরিকল্পনা রয়েছে। সেটি সুলতানি আমলের পূর্বে আমাদের বাংলার প্রাচীন কাল নিয়ে। আমি বর্তমানে ওই কাজের জন্য ডাটা সংগ্রহের পর্যায়ে রয়েছি। আগের কাজগুলি করার জন্য যেভাবে প্রথমদিকে আমি মুদ্রা সংগ্রহের দিকে মনোনিবেশ করেছিলাম এবং পরবর্তীতে সেই সংগ্রহ আমাকে লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, ঠিক একইভাবে আমি বর্তমানে এগুচ্ছি। আমদের পরিকল্পনা আছে বাংলার সেই সময় কালের কৃষ্টি-কালচার-অর্থব্যবস্থাকে তুলে ধরা। এটা খুব একটা সহজ হবে না সেটা আমরা জানি। আমি এ বিষয়ে ডাটা কালেকশন এর পর্যায়ে রয়েছি। এ বিষয়ে কাজ খুব কম হয়েছে। ডেটার স্বল্পতা রয়েছে। সে গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ খুব কম। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাবো ইনশাআল্লাহ।াগ্য হয়েছে।
পরিকল্পনা করি, যেহেতু বাবা-মা এর একমাত্র ছেলে আমি। রাবিতেই পিএইচডি করলাম।
নিজের শেকড়কে আগের চেয়ে বেশি চিনতে পেরেছি। আমি কে? এর একটা পরিচয় আমি জানতে পেরেছি এ গবেষণায় এসে। এখন আমি বলি, বাংলাদেশি তো বটেই তবে বাঙালি হিসেবেও জাতিয়তাবাদ সঠিক।
যাওয়ার আগে...
আমাদের বিনামূল্যের নিউজলেটারগুলি প্রতিদিন সকালে আপনার ইনবক্সে উজ্জ্বলতম একাডেমিক লেখকদের কাছ থেকে সরাসরি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য নিয়ে আসে।