এক ঘুম ভাঙা সিংহের উপাখ্যান
Published : May 20 2025 , 5:43:49 am
Written By : bdfeature
যুগে যুগে লাখ কোটি মানুষ আগমন করছে পৃথিবীতে, আবার বিদায়ও নিচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীতে সবাই স্মরণীয় হয়ে থাকে না। পৃথিবীতে তারাই স্মরণীয় হয়ে থাকে, যারা পৃথিবীর পরিবর্তনে নিজেদের উৎসর্গ করেছে। তেমনি, যখন তুরস্কে ইসলাম ছিল নিষিদ্ধ। মুসলিম নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতে ভয় পেত। আল্লাহর ফরজ বিধান পালনে থাকত বাধা। ভয়ে সবাই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তখনই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে এক ঘুম ভাঙা সিংহের আবির্ভাব হয়। তার নাম প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান হোজা।
তিনি ১৯৬৯ সালে প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর পরামর্শে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন এবং মাত্র ১০ জন উন্মাদকে নিয়ে মিল্লি গুরুশ (ইসলামি ভিশন) আন্দোলনের যাত্রা শুরু করেন। এরবাকান হোজা দল গঠনের পরপরই বলেছিলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আমরাই থাকব।’ নির্বাচনের ফলাফলে মিল্লি সালামেত পার্টির আসনসংখ্যা মাত্র ৪৮টি। বাধ্য হয়ে CHP মিল্লি সালামেত পার্টির দাবি (৫ মন্ত্রণালয় ও ভাইস প্রাইম মিনিস্টার পদ দেওয়ার শর্তে) কোয়ালিশন করে। সেদিন এরবাকান মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন, এখন ক্ষমতায় কারা? মাত্র ৪৮টি আসন নিয়ে ১৯৭৪ সাল থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৪ বছরের ক্ষমতায় আমেরিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুসলিমদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেন সফরে যায়। তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় এরবাকানের ওপর। তিনি কালক্ষেপণ না করে সেনাবাহিনীকে সাইপ্রাস দখলের নির্দেশ দেন। আমেরিকার এয়ারক্রফট যদি আসে সেখানেও হামলার নির্দেশ দেন।
সেদিন সাইপ্রাস বিজয়ের পর কথা বলার সাহস হয়নি আমেরিকার। পরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী দ্রুত বিটেন ত্যাগ করে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়। ১৯৭৪-এর সাইপ্রাস বিজয়ের পর তুরস্কের ওপর Embargo বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা। সে সময় তুরস্কের ইসলামপন্থিসহ অনেকেই তাকে দোষারোপ করেছিল এবং শঙ্কিত ছিল আমেরিকার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। এরবাকান সংসদে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে আমেরিকার ভয়ে ভীতুদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা আমার কী করবে?’ এই সিংহ পুরুষ এরবাকান সেই সময় আমেরিকার এমবার্গো দেওয়াকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে আমেরিকার ২৫টি ঘাঁটি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে তুরস্কের পতাকা উড়িয়ে দেয়।
১৯৮০ সালে এরবাকান হোজার দল বিরোধী দলে ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় পরে তুরস্কের মাটিতে আমেরিকার সব সামরিক ঘাঁটি চালু করা হয়। আজ এসব ঘাঁটি থেকেই প্রতিনিয়ত বিমান হামলা হচ্ছে সিরিয়ায় ও ইরাকে। আর নিহত হচ্ছে নিষ্পাপ মুসলিম শিশুরা।
এরবাকান হোজা তুরস্কের অবকাঠামোগত উন্নয়নেও মনোযোগ দিয়েছিলেন। তার দল মিল্লি সালামেত ও রেফাহ পার্টির শাসনামলে ১৮টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ১৬টি সার কারখানা, ১৪টি চিনির ফ্যাক্টরি, ২৩টি সুমের ব্যাংক ফ্যাক্টরি, ৬টি উদ্ভিদ ফ্যাক্টরি, ৭৭টি বৃহৎ শিল্প সেবা প্রতিষ্ঠান, ৬৩টি Organized industrial Zone, ২৫৩টি ছোট শিল্প-কারখানা, ৩২টি বৃহৎ মেশিনারি ফ্যাক্টরি, ৪টি নৌ-কারখানা, ১০টি ইঞ্জিন ফ্যাক্টরি, ১১টি ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল শিল্প কারখানা, ৩টি গবেষণা সেন্টার (প্রাকৃতিক সম্পদ), ৪টি ইলেকট্রোনিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন এবং সর্বশেষ Taksan প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ফ্যাক্টরি বানানোর ফ্যাক্টরি ছিল। এটাই সত্যিকারের উন্নয়ন। যারা রাস্তাঘাট আর বিল্ডিংয়ের মধ্যে উন্নয়ন খোঁজে তারা হয় অন্ধ, না হয় অজ্ঞ। কেননা, এই সাদা বিল্ডিং আর রাস্তাঘাট আমাকে আপনাকে খাবার দেবে না। রেড ইন্ডিয়ানরা একটা কথা বলেছিলেন, ‘যখন নদীর মাছ শেষ হয়ে যাবে, গাছপালা ধ্বংস হয়ে যাবে, খাবারের অবশিষ্ট্য আর কিছুই থাকবে না, তখন এই সাদা চামড়ার ব্রিটিশরা বুঝতে পারবে যে, টাকা চিবিয়ে খাওয়া যায় না।’ বর্তমান সময়ে ভারী শিল্পে উন্নয়ন ছাড়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তুরস্কের শিল্পবিপ্লব ঘটান। এ জন্যই এরবাকান হোজাকে তুরস্কের শিল্প বিপ্লবের অঘোষিত জনক বলা হয়।
আমেরিকা, ইসরায়েল, ন্যাটোর ভয়ে যখন কেউ নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিল না, তখন প্রফেসর এরবাকান ক্ষমতায় থেকে হোক আর না থেকেই হোক অসহায় মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সর্বদা মুসলিমদের ঐক্যের জন্য কাজ করেছেন এবং আমেরিকাণ্ডইসরায়েলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কট্টর ছিলেন। একবার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল প্রফেসর এরবাকানকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হোজা, আমেরিকার সঙ্গে আমরা কীভাবে পেরে উঠব?’
এরবাকান হোজা হেসে বলেছিলেন, ‘তুমি এ কথা বলার মাধ্যমেই নিজেকে ওদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসে ও গোলামে পরিণত করেছ। মিল্লি গুরুশ কী, তুমি কী ভুলে গিয়েছ? আমরা শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য নয় বরং সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য রাজনীতি করি।’
তিনি সব সময় জায়োনিজমের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করতে এবং একটি বাসযোগ্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। প্রফেসর ড. এরবাকান ১৯৯৭ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কোনো হামলা করার সাহস দেখায়নি। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনারা কী কারণে ফিলিস্তিনে হামলা করেননি?’ উত্তরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি এক দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পেয়ে সাইপ্রাস দখল করে নিতে পারে, তার ক্ষমতাকালে ফিলিস্তিনে হামলা করা আত্মহত্যার শামিল।’
ড. এরবাকান হোজা তার ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবদ্দশায় তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন মাত্র পঁচিশ বছর। আর বাকি ১৫ বছর তার কেটেছে জেলে অথবা রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ অবস্থায়। তিনি একাধারে একজন প্রধানমন্ত্রী, গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, কোরআনের হাফেজ, আলেম ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। এই সাহসী সিংহ পুরুষ ২০১১ সালে আল্লাহর জিম্মায় চলে যান। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের উত্তম স্থান দান করুন।
পরিশেষে, প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ভাষায় বলি, ‘ইসলামের বাইরে সত্যের কোনো উৎস নেই, অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য আর কোনো সত্য নেই। আমার পরেও তোমরা তোমদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ো না। বিজয় মুমিনদের জন্য এবং তা অতি নিকটবর্তী।’
যাওয়ার আগে...
আমাদের বিনামূল্যের নিউজলেটারগুলি প্রতিদিন সকালে আপনার ইনবক্সে উজ্জ্বলতম একাডেমিক লেখকদের কাছ থেকে সরাসরি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য নিয়ে আসে।