পুলিশের গুলিতে মেধার মৃত্যু : শাসকের পতনের সূচনা।
Published : July 03 2025 , 6:04:21 pm
Written By : bdfeature
সাবের হোসেন সৌরভ
প্রথম অংশ :
পুলিশ ক্যাম্পাসে এসে গুলি চালিয়ে কি শুধুই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছে ! নাকি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে ।
১৯৫২ সালের পাকিস্তানি পুলিশ আর আজকের পুলিশের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? পুলিশ আমাদের টাকায় ভাত খায় , আর আমাদের বুকে গুলি চালায়। আপনার সন্তানও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মানুষ হবে। আইন তো মানুষের জন্য, জনগণের জন্য। কোন আইনের ভিত্তিতে আপনার গুলি আমাদের বুকে লাগে ? সংবিধান আমাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আমি কোটা সংস্করণের বিষয়ে কথা বলার পূর্ণ অধিকার রাখি। সংবিধানের ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদ আগে বাতিল করুন, তারপর গুলি করবেন। এর আগে এমন নির্যাতন করার অধিকার আপনার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তান ছাড়া কেউ গুলি চালায়নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে গুলি করত, আর আপনি DC, SP অফিস থেকে এসে গুলি করছেন। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কথা না শুনেন, তাহলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে , আপনি দেশ চালান। ক্ষমতার দাপট দেখানোর মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা যাবে না। ফেরাউনের শাসনামলে যেমন সমাজ ব্যবস্থা শোচনীয় ছিল, তেমনি গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসনে লিবিয়া ভেঙে পড়েছিল। একদিন আপনাকেও সব ছেড়ে যেতে হবে।
শেখ মুজিব বলেছিলেন, "সময় শেষ হয়ে এলে মানুষ পদে পদে ভুল করে।" যদি এই দেশ পাকিস্তানের চেয়ে ভালো থাকে, তাহলে আমরা আমাদের দাবি আদায় করব। আর যদি পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ হয়, তাহলে দাবি আদায় করতে পারব না। জাতিকে মেধাশূন্য করে দেশ চালানোর চিন্তা করলে, তা ভুল হবে ।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মেধাবীদের ঘর। এই ঘর থেকে দেশের ভবিষ্যৎ জাতির কারিগর তৈরি হয়। আপনি সেই ঘরে এসে হামলা করছেন। জাতিকে মেধাশূন্য করার বা মেধাবীদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা যদি কারও থাকে, তাহলে তা ভুল হবে। আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, “একটি জাতিকে হয় পড়তে হয়, নয়তো পিছিয়ে পড়তে হয়।” ছাত্রসমাজ মেধাবী না হলে জাতির অধিকার নিয়ে কথা বলবে কে? তাদের মেধা ধ্বংস করে দিয়ে আপনি আপনার মত কাজ করবেন, আর ছাত্রসমাজ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকবে। এভাবে দেশ চলে না।
আমাদের চিন্তাবিদরা চিন্তার ঘরে বসে আছেন। চিন্তা করা ভালো, কিন্তু যারা জাতির ক্ষতি করছে, তাদের কোনো ক্ষমা নেই। ছাত্রসমাজ তাদের রক্ত দিয়ে দেশ রক্ষা করছে। অশুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে আমাদের। যাদের পাহারাদার রেখেছি, তারাই চুরি করছে। এই সংবিধান, সমাজ, দেশ যদি আমাদের হয়, তাহলে দেশ আমাদের জন্য পরিচালনা করতে হবে।
আজ যদি আমরা ন্যায়-অন্যায় নিয়ে কথা না বলি, তাহলে কে বলবে? পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ডিফেন্স বাহিনী ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে, এমন নজির নেই। কখনো কি শুনেছেন, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড বা এমআইটিতে প্রশাসন গুলি চালিয়েছে? শোনেননি, কারণ এমন ঘটনা ঘটেনি। এই কারণেই তারা আজ পৃথিবী শাসন করছে। যে দেশে শিক্ষার এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনো সম্মান নেই, সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কী আশা করেন ?
আমরা যদি মেধাবীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে না পারি, তাহলে এই দেশ কার জন্য? আমরা কি তবে শেয়ালের থাবা থেকে বাঘের থাবায় পড়লাম, সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য ছাত্ররাই কাজ করবে এবং করতেই হবে। হয়তো সময় লাগবে। “কিছু মানুষকে সবসময়, আর সব মানুষকে কিছু সময় বোকা বানানো যায় কিন্তু সকল মানুষকে সবসময় বোকা বানানো যায় না"
(আহমদ ছফা)।
দ্বিতীয় অংশ :
সময় কখনো কাউকে ক্ষমা করে না, যা দেখলাম ২৪-এর আন্দোলনে। জুলাই ছিল আমাদের জন্য তাজা টগবগে রক্তাক্ত দিনগুলোর স্মৃতি। আমরা বিশ্বাস করি ইতিহাস বারবার ফিরে আসে এবং সবাইকে সজাগ করে যে আমি এসেছি। হাসিনার সময়ও একই রুটিন হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম এই স্বৈরশাসক আর থাকবে না। সবাই মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু ইতিহাস মিথ্যা বলে না। ১১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোই তাদের পতনের প্রথম ধাপ ছিল। ঐ দিন লেখাটির প্রথম অংশ লিখেছিলাম।
আমরা এই আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সমর্থন পেয়েছি, যা প্রমাণ করে জনগণের শক্তি অসীম। সত্যি কথা বলতে গেলে পৃথিবীর কোনো শাসক রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার পর এটি মনে করে না যে , একদিন তাকে এসব ছেড়ে দিতে হবে এবং সেটি যে কোনো দিন চলে যেতে পারে। সবগুলোই প্রায় একই প্রকৃতিতে শাসন করতে চায়। আমি বলব না শেখ হাসিনা শুধু এমন শাসন করতেন, বরং আরও অনেক শাসক যুগে যুগে এমন শাসন করেছেন।
আমরা যদি ৫ হাজার বছর আগের সুমের শাসনের দিকে তাকাই, সেখানে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা এবং শাসন। এরপর আসে আক্কাদীয়দের যুগ। তারা এসে সুমের জয় করে। এই আক্কাদীয়দের নেতা বা শাসক ছিলেন সার্গন। ইতিহাসে সভ্যতার আদি বিজয়ী নায়ক হিসেবে তার নাম উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়। সার্গন ছিলেন খুবই হিংস্র প্রকৃতির, যে নিজের ভালো ছাড়া আর কিছুই বুঝত না। সে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে এবং সভ্যতার অনেক নিদর্শন বিলীন করে দেয়। শুধু হত্যা বা ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হতো না। সে যে অন্যায়গুলো করত, সেগুলো শক্ত কিছুতে খোদাই করে লিখে রাখত। তার একটি নীতি, যা বহু বছর পরে খোদাই অবস্থাতেই পাওয়া যায়, তাতে লেখা ছিল, “এই ব্যক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, আমি তাকে হত্যা করেছি। আমার বিপরীতে যে-ই দাঁড়াবে, আমি তাকেই হত্যা করব।” কিন্তু কালক্রমে সব অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
আমাদের গত শাসকও এমন ছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন কেউ তাকে ফেলতে পারবে না। কিন্তু তার এমন পালিয়ে যাওয়ার বিষয় স্বয়ং জরথুস্ত্রও জানতেন না। অথচ যে বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল, তা সকালে ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাত খাওয়ার পরেই সমাধান করা যেত। কিন্তু এতো শহীদের রক্তে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের আত্মাত্যাগের মূল্য কি আমরা দিতে পারবো.!!
লেখক পরিচিতি:
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
যাওয়ার আগে...
আমাদের বিনামূল্যের নিউজলেটারগুলি প্রতিদিন সকালে আপনার ইনবক্সে উজ্জ্বলতম একাডেমিক লেখকদের কাছ থেকে সরাসরি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য নিয়ে আসে।